প্রকাশিত: ২৩/০৮/২০১৮ ৮:৩৬ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
সৈকত শহর কক্সবাজারে এই ঈদের ছুটিতে যাঁরা ভ্রমণে আসবেন, তাঁদের জন্য একটা সুখবর আছে। তা হচ্ছে হোটেল-রিসোর্টে কম ভাড়ায় থাকার সুযোগ।ধরুন, আগে আপনি সৈকত-তীরের পাঁচ তারকা হোটেল সিগাল, ওশান প্যারাডাইস, লং বিচ অথবা প্যাঁচারদ্বীপের তারকা মানের পরিবেশবান্ধব পর্যটনপল্লি মারমেইড বিচ রিসোর্টে এক রাতের জন্য কক্ষভাড়া দিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। এখন দেবেন ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, আপনি ৫০ শতাংশ রেয়াত পাচ্ছেন। আর অন্য হোটেল, মোটেল, কটেজ ও গেস্টহাউসগুলো পাচ্ছেন ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ রেয়াত। ছাড়ের বিশেষ এই সুবিধা নিতে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই শহরের হোটেল-রিসোর্টে এই কম ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা থাকছে বলে জানিয়েছেন হোটেল মালিকেরা।

আজ ঈদুল আজহা। প্রতিবছর দুই ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটক। গত রোজার ঈদে টানা নয় দিনের ছুটিতে সৈকত ভ্রমণে আসেন অন্তত সাত লাখ পর্যটক। এ সময় হোটেল, মোটেল, কটেজ, গেস্টহাউস ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা হয়েছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকার।

কিন্তু এবারের ঈদুল আজহার ছুটিতে একটু ব্যতিক্রম হচ্ছে। বৈরী পরিবেশের সঙ্গে থেমে থেমে হচ্ছে ঝড়বৃষ্টিও। এ রকম পরিস্থিতিতে পর্যটক আসবেন কি না, তা নিয়ে হোটেল মালিকদের সংশয় ছিল।

কিন্তু বিনোদনপ্রিয় মানুষকে ঠেকায় কে? ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা ছুটে আসছেন বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে। ঘুরে বেড়াবেন টেকনাফের নাফ নদী, মগ জমিদারকন্যা আর সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্যের শতবর্ষের ঐতিহাসিক প্রেমের নিদর্শন মাথিন কূপ, নাফ নদীর জালিয়ারদিয়া, মিয়ানমার সীমান্তের রাখাইন রাজ্য, রামু বৌদ্ধপল্লি, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরসহ শহরের বার্মিজ মার্কেট। যে মার্কেটের বিক্রেতারা হচ্ছেন রাখাইন ও পাহাড়ি তরুণ-তরুণী।

এবার একটা দুশ্চিন্তার খবর দিই। সেটি হচ্ছে বিশেষ রেয়াতের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যে অধিকাংশ হোটেল-মোটেলের কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যে কক্ষগুলো খালি আছে, তার জন্য আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের কলাতলী এলাকার এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় তারকা মানের আটটিসহ হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ আছে প্রায় ৫০০টি। এসব হোটেলে দৈনিক দেড় লাখ মানুষের রাত যাপনের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে কটেজ আছে ১৬৫টি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন কটেজে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ, কটেজে একটি কক্ষ ৪০০ থেকে ২০০০ টাকায় পাওয়া যায়। কম খরচের খাওয়া এবং বিনোদনের নানা সুযোগও কক্ষগুলোতে রাখা হয়। নিরাপত্তার জন্য কটেজগুলোয় আছে সিসিটিভি।

এর সত্যতা নিশ্চিত করে কক্সবাজার কটেজ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি কাজী রাসেল আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে তাঁরা (কটেজ মালিকেরা) সর্বোচ্চ (৬০%) রেয়ার দিচ্ছেন। উদ্দেশ্য, নিম্ন আয়ের পরিবারের লোকজনকে সৈকত ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া। পাশাপাশি অতিথিদের তাঁরা ফুল দিয়ে বরণ করে ঈদের শুভেচ্ছা জানাবেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কটেজগুলোয় ৬০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। অবশিষ্ট কক্ষগুলোও দ্রুত ভাড়া হয়ে যাবে। তবে প্রতিটি কটেজে তাঁরা পাঁচটি করে কক্ষ খালি রাখবেন, যাঁরা বুকিং না দিয়ে কক্সবাজার চলে এসে কক্ষ না পেয়ে বিপদে পড়ছেন, তাঁদের জন্য।

হোটেল মালিকেরা বলেন, এখন শহরের হোটেল-মোটেলগুলো প্রায় খালি। ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে পর্যটক আসা শুরু হবে। ২৬ আগস্ট পর্যন্ত চার দিনে অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে সৈকতে। এরপর সংখ্যাটা কমতে শুরু করবে।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, কোরবানির ঈদের ছুটিতে পাঁচ লাখ পর্যটক এলে অন্তত ৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁসহ শুঁটকি মাছ ও শামুক-ঝিনুকের পণ্য কেনাকাটা পর্যটকের ক্রয় তালিকায় থাকেই।

সৈকতের সঙ্গে লাগোয়া পাঁচতারকা হোটেল সিগাল। এই হোটেলে কক্ষ আছে ১৭৯টি। অতিথিদের জন্য তারা ছাড় দিয়েছে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ। আছে বিনা মূল্যে সকালে নাশতা, সুইমিংপুলে গোসল, বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আনা-নেওয়াসহ বিনোদনের নানা সুবিধা।

সিগাল হোটেলের প্রধান নির্বাহী ইমরুল সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কক্সবাজারের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল হিসেবে আমরা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সৈকত ভ্রমণে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিই, সেটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব না। কারণ, আমরা সেবাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অতিথি ছাড়াও স্থানীয় লোকজনও হোটেলের সুবিধা নিচ্ছেন।’

সিগাল হোটেলের ব্যবস্থাপক নূর আলম বলেন, ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনের জন্য হোটেল সব কক্ষ ইতিমধ্যে অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। এখন ২৬ থেকে ৩০ আগস্টের বুকিং চলছে। তার মধ্যেও ৫০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে।

সিগাল হোটেলের পাশে আরেক তারকা হোটেল দ্য কক্স টু ডে। এই হোটেলেও ৯০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। হোটেলের পরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্ষাকালে ভ্রমণে উৎসাহিত করতে তাঁরাও ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রেয়াত দিচ্ছেন।

শহরের তারকা হোটেল সায়মান বিচ রিসোর্ট, ওশান প্যারাডাইস, লং বিচ হোটেল, হোটেল সি প্যালেস, হোটেল ওয়েস্টার্নের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে।

বিদেশি পর্যটকদের কাছে পছন্দের হোটেল প্যাঁচার দ্বীপ সৈকতের পরিবেশবান্ধব ইকো ট্যুরিজমপল্লি মারমেইড বিচ রিসোর্ট।

এই রিসোর্টের জিএম মাহফুজুর রহমান বলেন, তাঁদের এই পল্লিতে ১০০ জন অতিথি থাকতে পারেন। ঈদের পরদিন থেকে কোনো কক্ষ খালি নেই।

শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপ সি পালের অবস্থা ভিন্ন। সেখানে অতিথি তেমন নেই।

কক্সবাজারের কয়েকটি হোটেল মালিকদের সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফেডারেশন অব কক্সবাজার ট্যুরিজম সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে সৈকতে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটকের ঢল নামবে। পর্যটকদের বরণ করতে আমরা প্রস্তুত। ৯৮ শতাংশ হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস পর্যটকদের জন্য ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কক্ষভাড়া ছাড় দিলেও হাতে গোনা কয়েকটি হোটেল অতিরিক্ত ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তৎপর হওয়া উচিত।’

কক্সবাজার পর্যটন উন্নয়ন সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক সেলিম নেওয়াজ বলেন, যেসব হোটেল গলাকাটা ব্যবসা করে, তাদের চিহ্নিত করা দরকার। পাশাপাশি পর্যটকেরা নিরাপদে যেন ঘোরাফেরা করতে পারেন, সে জন্যও প্রশাসনকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কারণ, পর্যটকের চাপ বাড়লে অপরাধীরাও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, ঈদের দ্বিতীয় দিন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দেড় লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটবে। এরপর আরও দুদিনে আসবেন আরও তিন লাখের বেশি মানুষ। তাঁরা সৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি মেরিন ড্রাইভ, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানীর পাথুরে সৈকত, রামু বৌদ্ধমন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, টেকনাফের মাথিন কূপ, জালিয়ারদিয়া, নাফ নদী, আদিনাথ মন্দিরে পরিদর্শন করবেন। এ সময় বাড়তি নিরাপত্তা প্রয়োজন। কারণ, কক্সবাজারে এখন চার হাজারের বেশি বিদেশি অবস্থান করছেন। কোনো ধরনের অপরাধকর্ম সংগঠিত হলে পুরো হোটেল ব্যবসায় ধস নামবে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলে রাব্বি বলেন, চার-পাঁচ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদাপোশাকেও পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। তবে উত্তাল সমুদ্রে গোসলে নামার আগে পর্যটকদের জোয়ার-ভাটার নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানান তিনি। জোয়ারের সময় গোসলে নামা নিরাপদ। এ সময় সৈকতে উড়ানো হয় সবুজ নিশানা। আর ভাটার সময় গোসল করা নিষিদ্ধ। কারণ, এ সময় স্রোতের টান প্রবল থাকে। ভাটার সময় যেন লোকজন সমুদ্রে না নামেন, এ বিষয়ে সতর্ক করতে সৈকতে উড়ানো হয় লাল নিশানা। কিন্তু অনেকে নির্দেশনা অমান্য করে সমুদ্রে নেমে বিপদে পড়েন। গত ২০ দিনে সৈকতের গোসলে নেমে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজন বিদেশি, তিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তা। অপর দুজন রাজধানীর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

সৈকতের পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইয়াছির লাইফগার্ড স্টেশনের পরিচালক ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডুবুরি মোস্তফা কামাল বলেন, সৈকতে এখন উত্তর-দক্ষিণ লম্বা কয়েকটি গুপ্ত খালের সৃষ্টি হয়েছে। ভাটার স্রোতে ভেসে গিয়ে কেউ খালে আটকা পড়লে উদ্ধার করা কঠিন।

সৈকতে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সেলিম শেখ বলেন, ঈদের দিন থেকে সৈকতে ভ্রাম্যমাণ আদালত সক্রিয় থাকবে। আরও কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত হোটেল-মোটেলগুলোয় নজরদারি রাখবেন, যাতে অতিরিক্ত কক্ষভাড়া ও রেস্তোরাঁগুলোয় খাবারের অতিরিক্ত দাম হাতিয়ে নেওয়া না হয়। এ ব্যাপারে হোটেল মালিকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।প্রথম আলো

পাঠকের মতামত